স্বাধীনতা কাপ চ্যাম্পিয়ন আবাহানী
স্পোর্টস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১৯ ডিসেম্বর ২০২১ ০১:০৯; আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:০০

কিংসকে হারিয়েই ২০১৮ সালের ফেডারেশন কাপের শিরোপা জিতেছিল আবাহনী। এর পরের সময়টাতে তারা শুধু কিংসের সাফল্যই দেখেছে। স্বাধীনতা কাপে এসে এবার পাশার দান উল্টালো লেমোসের দল।
আগের চার ম্যাচে গোল না পাওয়া রাকিব হোসেন মহাগুরুত্বপূর্ণ ফাইনালে এসেই কাজের কাজটি করলেন। বসুন্ধরা কিংসের জালে গোল উৎসব করলেন ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড দোরিয়েলতন গোমেজ নাসিমেন্তোও। দারুণ জয়ে তিন দশক পর স্বাধীনতা কাপের মুকুট ফিরে পেল আবাহনী লিমিটেড।
কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে শনিবার গত আসরের চ্যাম্পিয়ন কিংসকে ৩-০ গোলে হারিয়েছে মারিও লেমোসের দল। প্রতিযোগিতাটির ১৯৯০ সালের চ্যাম্পিয়ন আবাহনী দুটি গোলই করেছে দ্বিতীয়ার্ধে।
২০১৬ সালে সবশেষ ফাইনালে উঠেছিল আবাহনী, সেবার চট্টগ্রাম আবাহনীর কাছে ২-০ গোলে হেরেছিল তারা। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২০১৮ সালে ফেডারেশন কাপ জয়ের পর এই প্রথম শিরোপার স্বাদ পেল আকাশী-নীল জার্সিধারীরা।
ঐতিহ্যবাহী আবাহনী আর ঘরোয়া ফুটবলের নতুন পরাশক্তি হয়ে ওঠা কিংসের দ্বৈরথে গ্যালারি ছিল দর্শকে ঠাসা। হাজার দশেক সমর্থক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন।
জোনাথন দি সিলভেইরা ফের্নান্দেস, তপু বর্মন ও কাজী তারিক রায়হানকে চোটের কারণে ফাইনালে পায়নি কিংস। প্রথমার্ধে আবাহনীর চেয়ে আক্রমণে কিছুটা পিছিয়ে ছিল তারা।
আগের ম্যাচের একাদশে একটি পরিবর্তন আনেন আবাহনী কোচ মারিও লেমোস। নাবীব নেওয়াজ জীবনের বদলে আক্রমণভাগে খেলান ব্রাজিলিয়ান দোরিয়েলতনকে।
কিংস ছেড়ে এক মৌসুম পর আবাহনীতে ফেরা দেনিয়েল কলিনদ্রেস সোলেরার হাত ধরে প্রথম আক্রমণে ওঠে আবাহনী। কিন্তু দশম মিনিটে কোস্টা রিকার এই ফরোয়ার্ডের দুর্বল হেড জমে যায় আনিসুর রহমান জিকোর গ্লাভসে। পরের মিনিটেই কিংসের ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড রবসন দি সিলভা রবিনিয়োর ভলি ক্রসবারের উপর দিয়ে যায়।
অষ্টাদশ মিনিটে কলিনদ্রেসের ফ্রি কিক অনেকটা লাফিয়ে গ্লাভসের ছোঁয়ায় কর্নারের বিনিময়ে ফেরান জিকো। দুই মিনিট পর ডান দিক থেকে রাকিব হোসেনের ক্রসে বল আতিকুর রহমান ফাহাদের পায়ে লেগে পেয়ে যান কলিনদ্রেস, কিন্তু ৩৬ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড তালগোল পাকিয়ে শেষ পর্যন্ত শটই নিতে পারেননি।
২২তম মিনিটে ইস্তয়ান ভ্রানিয়াসের দূরপাল্লার শট ফিস্ট করে ফেরান আবাহনীর গোলরক্ষক মাহফুজ হাসান প্রীতম। একটু পর বসনিয়া-হার্জেগোভিনার এই ফরোয়ার্ডের ফ্রি কিক অল্পের জন্য ক্রসবারের উপর দিয়ে যায়।
৩৬তম মিনিটে কিংসের এগিয়ে যাওয়ার আরেকটি ভালো সুযোগ নষ্ট হয়। মাঝমাঠের একটু উপর থেকে রবিনিয়ো হঠাৎ লম্বা পাস বাড়ান বক্সে। কিছুটা অপ্রস্তুত থাকা ভ্রানিয়াস পা ছোঁয়ালেও বলের নিয়ন্ত্রণ ঠিকঠাক নিতে পারেননি। প্রথমার্ধের শেষ দিকে রাফায়েলের ক্রসে দোরিয়েলতনের হেড ড্রপ খেয়ে গতি হারিয়ে জিকোর কাছে যায়।
দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম ভালো আক্রমণ থেকে এগিয়ে যায় আবাহনী। রাফায়েলের দারুণ থ্রু পাস ধরে গায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকা ইয়াসিন আরাফাতকে গতিতে পরাস্ত করে আগুয়ান জিকোর পাশ দিয়ে নিখুঁত শটে লক্ষ্যভেদ করেন রাকিব। উল্লাসে ফেটে পড়ে আবাহনীর ডাগআউট, গ্যালারিতে আসা আকাশী-নীল সমর্থকরাও। চলতি আসরে এই প্রথম গোল পেলেন রাকিব।
৬১তম মিনিটে রিমন হোসেন বক্সে কলিনদ্রেসকে ফাউল করলে পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। সিদ্ধান্তটি নিয়ে অসন্তোষ জানিয়ে রেফারিকে ঘিরে ধরেন কিংসের খেলোয়াড়রা। এ নিয়ে কিছুটা উত্তেজনা দেখায় বটে, কিন্তু সিদ্ধান্ত বদলায়নি। দোরিয়েলতন স্পট কিকে ব্যবধান দ্বিগুণ করেন।
পাঁচ মিনিট পর শুরুতে ইমন বাবুর শট এবং এরপর রাকিবের ফিরতি হেড আটকে ব্যবধান বাড়তে দেননি জিকো। ৭২তম মিনিটে ছোট ডি-বক্সের একটু উপর থেকে দারুণ শটে আবাহনীর জয় অনেকটাই নিশ্চিত করে দেন দোরিয়েলতন।
আপেক্ষা ফুরাল লেমোসেরও। ২০১৮ সালে আবাহনীর দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে পারলেন ৩৫ বছর বয়সী এই পর্তুগিজ কোচ।
পেনাল্টি থেকে গোল করে জার্সি খুলে সোজা গ্যালারির দিকে ছুটে যান ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড ডরিয়েলটন গোমেজ। তার গোলেই বসুন্ধরার বিপক্ষে স্পষ্ট ২ গোলে এগিয়ে যায় আবাহনী।
তাই ডরিয়েলটনের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন সতীর্থরাও। উচ্ছ¡াসে ভেসে যায় আবাহনীর গ্যালারি। ডরিয়েলটন ঝলকে তৃতীয় গোলের দেখাও পায় আকাশী হলদু শিবির। তিন মিনিটে দুই গোল হজম করে ম্যাচ থেকে এক প্রকার ছিটকে যায় বসুন্ধরা কিংস।
মাঠে নামার আগে আবাহনীর সবার গায়ে ৮ নম্বর জার্সি। উপলক্ষ্য প্রাণতোষ কুমার দাসকে ঘরোয়া আসর থেকে বিদায় দেওয়া। আাগেই প্রাণতোষ জানিয়েছিলে, এই ম্যাচেই ২৭ বছরের ফুটবল ক্যারিয়ার থেকে অবসর নেবেন তিনি। পরে অবশ্য নিজেদের জার্সিই পড়েন সবাই।
ক্যারিয়ারে ১৮ বছরই প্রাণতোষ খেলেছেন আকাশী হলুদ জার্সি গায়ে। খেলা ছাড়লেও ফুটবলকে ছাড়ছেন না বলেই জানান তিনি। প্রাণতোষের কথা, ‘খেলা ছাড়লেও আমি ফুটবল ছাড়ছি না। আবাহনীর কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে রাখতে চাই নিজেকে।’ ক্লাব ও জাতীয় দলের মধ্যমাঠের ফুটবলার হিসেবে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন প্রাণতোষ। জাতীয় দলে খেলেছেন ২০০৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত।
২০১৬ সালে মালদ্বীপে গিয়ে যে ম্যাচে বাংলাদেশ ৫-০ গোলে হেরেছিল, ওই ম্যাচটি জাতীয় দলের জার্সিতে ছিল প্রাণতোষের শেষ ম্যাচ। এবার ঘরোয়া ফুটবল থেকেও অবসর নিলেন ৩৯ বছর বয়সী এই ফুটবলার। শিরেপা জিতেই প্রাণতোষকে বিদায় জানালেন লেমোসের শিষ্যরা।
জাতীয় দলের দুই কোচের লড়াই। একদিকে আবাহনীর পর্তুগীজ কোচ মারিও লেমোস। অন্যদিকে বসুন্ধরা কিংসের স্প্যানিশ কোচ অস্কার ব্রæজোন। সম্প্রতি দু’জনেই জাতীয় দলে কোচের দায়িত্ব পালন করেন। অস্কার মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে এবং লেমোস কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন শ্রীলকায় অনুষ্ঠিত চারজাতি ফুটবল টুর্নামেন্টে। স্বাধীনতা কাপে দুই বিদেশি কোচের লড়াইয়ে অস্কারকে হারালেন লেমোস।
স্বাধীনতা কাপের ফাইনাল। তাই কাল কমলাপুরে দুই দলের সমর্থকদের উপস্থিতিও ছিল দেখার মতো। উত্তর গ্যালারিতে লাল পতাকা নিয়ে হাজির ছিলেন বসুন্ধরা কিংসের সমর্থকেরা। দক্ষিণ গ্যালারিতে অবস্থান নেন আবাহনীর সমর্থকরা। তবে আবাহনীর চেয়ে বসুন্ধরার গ্যালারিতেই দর্শক সংখ্যা ছিল বেশি।
ম্যাচের শুরু থেকে আক্রমণাত্মক ছিল আবাহনীই। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের আক্রমণের ধারও বাড়তে থাকে। ২৫ মিনিটে আবাহনীর বড় সুযোগ নষ্ট হয়। রাফায়েল ফাঁকা পোস্টে বল তুলে দেন আনিসুর রহমান জিকোর হাতে। প্লেসিং করতে চেয়েও পারেননি তিনি।
৫৪ মিনিটে প্রথম গোলের দেখা পায় আবাহনী। আগোস্তো ডিফেন্স চেরা পাস দেন। বল পেয়ে বক্সের মধ্যে ঢুকে পড়েন ফরোয়ার্ড রাকিব হোসেন। বল ধরতে এসে পড়ে যান বসুন্ধরার গোলকিপার আনিসুর রহমান জিকো। সুযোগ বুঝে শুয়ে পড়ে বাঁ পায়ের প্লেসিং শটে বল জালে জড়ান রাকিব হোসেন (১-০)।
মিনিট সাতেক পর ব্যবধান দ্বিগুন করেন বল নিয়ে বক্সে ঢুকে পড়া কোস্টারিকার ফরোয়ার্ড দানিয়েল কলিনদ্রেসকে। রেফারি পেনাল্টির বাঁশি দেন। পেনাল্টি থেকে গোলে পরিণত করেন ডরিয়েলটন (২-০)।
দ্ইু গোল হজম করে খেই হারিয়ে ফেলে বসুন্ধরা কিংস। আক্রমণের ধার বাড়ানোর বদলে উল্টো তৃতীয় গোল হজম করে তারা। ৭১ মিনিটে কর্ণার থেকে রাফায়েল অগোস্তোর শট মিলাদ শেখ সোলাইমানির হেড ডরিয়েলটনের সামনে এসে পড়লে শট করে গোলে রুপ দেন সুযোগ সন্ধানী এই ব্রাজিলিয়ান (৩-০)। শেষে এই ব্যবধানেই চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী লিমিটেড।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: