ইসির আইন সংস্কার কার্যক্রমে গতি নেই
এমরান হোসাইন শেখ | প্রকাশিত: ১৩ মার্চ ২০২১ ০১:০৩; আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২১ ০১:১৩

বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) তার মেয়াদে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, স্থানীয় সরকার পরিচালনা আইনসহ বেশ কয়েকটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও তাতে গতি নেই। এসব আইনের মধ্যে কয়েক দফা সংশোধন শেষে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশোধনীটি আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং পর্যায়ে রয়েছে। তবে, ইসি এ আইনটি ব্যাপক সংস্কার করতে চাইলেও সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। পরে আইনটি কেবল বাংলায় প্রণয়ন ও সামান্য কিছু সংস্কারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এদিকে কমিশনারদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদাসহ সুযোগ সুবিধা বাড়াতে আরেকটি নতুন আইনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ইসি। সেখানে তারা নিজেদের প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা চেয়েছেন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার ৫ মাসের মাথায় ওই বছরের জুলাইয়ে বিস্তারিত রোডম্যাপ তৈরি করে। তাতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশসহ বিদ্যামান সকল আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এজন্য কমিশনার কবিতা খানমকে প্রধান করে আইন সংস্কার কমিটিও করা হয়। ওই কমিটি ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে শুরুতেই ‘দি ডিলিমিটেশন অর্ডিন্যান্স-১৯৭৬’ বাতিল করে ‘নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন-২০১৭’ প্রণয়ণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এতে আইনটি আমূল সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এজন্য টাকার বিনিময়ে এক্সপার্টও নিয়োগ করে। কিন্তু দফায় দফায় বৈঠক, নানা সংস্কার প্রস্তাবের পরও আইনটি আলোর মুখ দেখেনি। পরে নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় ২০১৮ সালের শুরুতে আগের আইনের অধীনেই নির্বাচনি সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে কমিশন। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ইসির সীমানা নির্ধারণের সেই আইনের বিষয়ে আর কোনও উচ্চাবাচ্চ্য দেখা যায়নি। এদিকে সংসদ নির্বাচনের আগে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশেরও ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেয় কমিশন। তবে, শেষ মেষ সরকারের চাহিদা মোতাবেক কেবলমাত্র সংসদ নির্বাচনে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহারের বিধান যুক্ত করে ওই আইনটির ক্ষুদ্র সংশোধনী হয়। অবশ্য সংসদ নির্বাচনের পরও আরপিও’র ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেয় কমিশন। এজন্য বিশেষজ্ঞও নিয়োগ দেওয়া হয়। ইসি ১৯৭২ সালের আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) রহিত করে ‘গণপ্রনিধিত্ব আইন ২০২০’ প্রণযনের উদ্যোগ নেয়। আদালতের নির্দেশনা মেনে এটিকে বাংলায়ও প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আলোচিত বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে আরপিও’র অংশ হিসেবে থাকা রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের বিধানটি আরপিও থেকে বাদ দিয়ে ‘রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইন-২০২০’ নামে নতুন পৃথক আইন প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেয় ইসি। নতুন এ আইনটির খসড়া প্রণয়নের পাশাপাশি এর পক্ষে বিপক্ষে রাজনৈতিক দলের মতামতও গ্রহণ করে ইসি। তবে, সরকারি দল আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজন আপত্তি জানালে এই আইনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় কমিশন। জানা গেছে, সরকারের তরফ থেকেও নিবন্ধনে পৃথক আইনের সায় মেলেনি।
আইন মন্ত্রণালয় ও কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আইনের নামসহ ভেতরকার অন্তত ৯টি মৌলিক ধারা বাদ দেওয়ার কারণে আইন মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যা চেয়ে কমিশনে ফেরত পাঠায় আপরিও’র খসড়া। পরে বেশ কয়েকদফায় ব্যাখ্যার জবাব দেওয়ার পর বর্তমানে আইনটি মন্ত্রণালয়ে ভেটিং পর্যায়ে রয়েছে।
গত বছর (২০২০) করোনার মহামারির সময় ‘রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইন-২০২০’ প্রণয়নের উদ্যোগের পাশাপাশি ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নির্বাচন আইন-২০২০’ প্রনয়ণের উদ্যোগ নিয়েছিল ইসি। একই আইনের অধীনে স্থানীয় সরকারের ৫টি প্রতিষ্ঠানের (সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ ও জেলা পরিষদ) নির্বাচন পরিচালনার জন্যে এ আইনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বর্তমানে প্রত্যেকটি আইনের অধীনে বিধিমালা করে এসব নির্বাচন পরিচালিত/অনুষ্ঠিত হয়। ইসির পরিকল্পনা ছিল— সদ্য সমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনের আগেই আইনটি প্রণয়ন করে তার অধীনে এবারের পৌরসভা নির্বাচনসহ সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন/উপনির্বাচন অনুষ্ঠান করা। কিন্তু আইনটি আলোর মুখ না দেখায় বিদ্যমান বিধির আলোকে ৫টি ধাপে পৌরসভা নির্বাচন সম্পন্ন করেছে ইসি। বিধির আলোকে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইতোমধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নির্বাচন আইন-২০২০’ প্রণয়নে রাজনৈতিক দলের মতামত চাইলেও তাতে সাড়া মেলেনি। নির্বাচন কমিশন গত বছরের ১ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোকে আইনের খসড়া পাঠিয়ে একমাসের মধ্যে মতামত পাঠাতে অনুরোধ করলেও কেউই জবাব দেয়নি বলে জানা গেছে।
নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের বেতন, ভাতাদি, পেনশন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত আইন-২০২০’ এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে। আইনটির বিষয়ে ইসি থেকে কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এরপর ইসির চূড়ান্ত অনুমোদন হতে পারে। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, নিজেদের সুযোগ সুবিধা বাড়াতে ইসির নতুন আইনে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও সায় মেলেনি। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের জন্য পৃথক আইন হলে পাবলিক সার্ভিস কমিশন ও মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের ক্ষেত্রেও নতুন আইনের দাবি আসবে। ফলে এটা নিয়ে একটি জটিলতা তৈরি হতে পারে। বর্তমানে এসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের সমান সুবিধাপ্রাপ্ত হন। এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট জাজেস (রেমুনারেশন অ্যান্ড প্রিভিলেজেস) আইন অনুসারে, তারা বেতন ভাতা পেয়ে থাকেন। অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিচারপতিরা যে সুবিধা পান তারাও সেভাবেই পেয়ে থাকেন।
বতর্মান কমিশনের চার বছরে আরপিও-তে ইভিএম মেশিনে ভোট গ্রহণ বিধানযুক্ত করে এই আইনটির সংশোধন এবং ভোটার হালনাগাদের চূড়ান্ত তালিকা ৩০ জানুয়ারির পরিবর্তে ২ মার্চ প্রকাশের বিধান করে বিদ্যমান ভোটার আইন সংশোধন ছাড়া অন্য কোনও আইনের সংস্কার হয়নি। বর্তমান কমিশনের বাকি ১১ মাসের মেয়াদে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বাংলায় রূপান্তরসহ কিছু বিধানের পরিবর্তন এনে এই আইনটির সংশোধন ছাড়া অন্য কোনও আইন প্রণয়ন বা সংস্কারের সম্ভবনা নেই।
আইনের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশোধনী কমিশনের অনুমোদনের পর আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখানে এটি ভেটিং পর্যায় আছে। ভেটিংয়ের পর অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষ হলে হয়তো পাস হবে। আর আইন তো আমরা পাস করি না, সংসদ করে। ফলে কবে হবে তা বলা যাবে না।’
রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনটি হচ্ছে না জানিয়ে আইন সংস্কার কমিটির প্রধান কবিতা খানম বলেন, ‘আমরা খসড়া করার পর রাজনৈতিক দলের মতামত চেয়েছিলাম। তাদের কাছ থেকে সাড়া না পাওয়ায় আলাদা আইনের সিদ্ধান্ত বাতিল হয়েছে। এটা বর্তমানের মতো আরপিও-তেই থাকছে।’ অন্যান্য আইনগুলো এখনও কমিশন পর্যায়ে রয়েছে বলেও জানান এই কমিশনার।
এদিকে ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নির্বাচন আইন-২০২০’ প্রসঙ্গে ইসি সচিবালয়ের উপ সচিব আব্দুল হামিদ বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক দলের কাছে এই আইনের বিষয়ে মতামত চেয়েছিলাম। কিন্তু কোনও দলের মতামত এখনও ইসিতে এসে পৌঁছেনি।’
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: